দিরাইয়ে বাড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষ
৯ মাসে ৫ খুন, ২০০ স্থাপনা ভাঙচুর ও লুট
- আপলোড সময় : ১৮-১০-২০২৪ ০৯:৪৯:৪৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৮-১০-২০২৪ ০৯:৪৯:৪৭ পূর্বাহ্ন
শহীদনূর আহমেদ ::
ছবিতে বিধ্বস্ত এই বসতঘরটি দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের মাতারগাঁও গ্রামের। সংঘর্ষে খুনের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের এমন অন্তত ৭টি বসতঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাটের দৃশ্য দেখে স্থম্ভিত হবে যে কেউ। বদলা নিতে প্রতিপক্ষের পাকা বাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনার অভিযোগ রয়েছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এর আগে ৪ অক্টোবর গ্রামে খাস জমির দখল নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের বন্দুকের গুলিতে খুন হন গ্রামের নইমুল নামের এক ব্যক্তি। সরকারি খাস জমি দখলের সাথে গ্রামের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব যুক্ত হয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় দারা মিয়া ও মকবুল আলীর গোষ্ঠীর মধ্যে। এতে আহত হন অন্তত ২০ জন। একদিকে স্বজনহারাদের প্রতিশোধকামী মনোভাব অন্যদিকে প্রতিপক্ষের নারী শিশুদের ঘরবাড়িহীন অনিরাপদ জীবনযাপন ক্রমশই অবনতি হচ্ছে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
জমি দখল, জলমহাল দখল, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জেরে চলতি বছরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৭টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে দিরাইয়ে। এতে ৯ মাসে ৫ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। এসব সংঘর্ষের ঘটনায় ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে অন্তত ২০০ ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।
বিগত সময়ে বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের মানিকদা গ্রামে খাস জমি নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে ফয়জন্নুর (৫৫) ও ২৬ জানুয়ারি রাজানগরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে শওকত আলী নিহত হন। ৫ ফেব্রুয়ারি তাড়ল ইউনিয়নের উজানদল গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আনোয়ার হোসেন (৫৫) নিহত ও উভয়পক্ষের ২০ জন আহত হন। ৮ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসা ফান্ডের টাকা নিয়ে রায়বাঙ্গালী গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ উভয় পক্ষের ২০ জন এবং জলমহালকে কেন্দ্র করে ১৬ সেপ্টেম্বর উপজেলার বদলপুর গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৫০ লোক। ২৯ আগস্ট রফিনগর ইউনিয়নে খাস জমি দখল নিয়ে দুই গ্রামের লোকদের সংঘর্ষে পারুল মিয়া (৬০) নিহত ও উভয়পক্ষের ৫০ জনের মতো আহত হয়েছেন বলে জানা যায়।
ঘটনা প্রবাহে দেখা যায়, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিরাইয়ে সংঘাত, সংঘর্ষ আর খুনোখুনি ঘটনা ঘটছে। সেইসাথে এসবের প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর-দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। স্থানীয়ভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্রমেই অনিরাপদ আর অসহনশীল হয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকা। এসব খুনোখুনির ঘটনার প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর-দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ব্যাপকতা বেড়েছে বহুগুণে। বদলা নিতে প্রতিপক্ষের পাকা বাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। বাড়িঘরের দরজা-জানালা খুলে নেওয়া থেকে শুরু করে গবাদিপশু, ধানচাল, গৃহস্থালির জিনিসপত্র লুটের ঘটনা ঘটছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। প্রতিপক্ষের ভয়ে পুরুষের পাশাপাশি বাড়িছাড়া হচ্ছেন নারী-শিশুরাও।
সর্বশেষ সংঘর্ষ ঘটে যাওয়া দিরাই উপজেলার মাতারগাঁও গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সংঘর্ষের ঘটনায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে এলাকায়। ঘটনা নিহত নইমুল হকের বাড়িতে শোকের মাতম বিরাজ করছে। পিতৃহারা নইমুলে চার শিশু সন্তান ও মানসিক প্রতিবন্ধীর স্ত্রীর আহাজারি কোনোভাবেই থামছে না। নইমুল হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন স্বজনরা।
এদিকে নইমুল হত্যাকা-ের ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের পর থেকে পলাতক রয়েছেন অভিযুক্ত মকবুল আলম চৌধুরীর লোকেরা। স্বজন হত্যার বদলা নিতে প্রতিপক্ষের বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটে অভিযোগ পাওয়া যায় দারা মিয়ার পক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষের লোকেরা অন্তত ৭টি পাকাঘর ও দুইটি দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নারী ও শিশুরা।
তাহমিনা বেগম নামের এক ভুক্তভোগী জানান, মারামারি ঘটনার পর থেকে আমাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাড়ি ছাড়া। এই সুযোগে দারা মিয়ার লোকেরা আমাদের ৭-৮টি বাড়ি ভাঙচুর করেছে। হাতুড়ি আর হেমার দিয়ে সকল ঘরে দেয়াল, দরজা জানালা আসবাবপত্র ভেঙে দিয়েছে। সকল ঘরে লুটপাট করেছে। গরু ছাগল নিয়ে গেছে। পরিবারের নারী শিশুরা মানুষের বাড়িঘরে আশ্রয়ে আছি। ভয়, আতঙ্ক আর অনিরাপদ অবস্থায় আছি আমরা। লুটপাটের ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে কিন্তু পুলিশ এখনো মামলা নেয়নি।
নাজমা বেগম বলেন, আমাদের ১০টি গুরু ও বাড়ি সামনের দোকান লুট করে নিয়ে গেছে। আমি বাঁধা দিলে ভয়ভীতি দেখানো হয়। আমরা খুব আশঙ্কার মধ্যে জীবনযাপন করছি। ৭-৮টি বাড়ির নারী পুরুষ বাড়ি ছাড়া। আমাদের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই।
ভাঙচুর ও লুটপাটের বিষয়ে অস্বীকার জানিয়ে দারা মিয়া পক্ষের শামছুল হক লিটন বলেন, অবৈধভাবে খাস জমি দখল করার প্রতিবাদ জানানোর কারণে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে নিরীহ নইমুলকে হত্যা করেছে। ঘটনার পর থেকে আমরা আতঙ্কে আছি। আমাদের কেউ তাদের কোনো কিছু নিয়ে আসেনি। কোনো ঘর বাড়ি বা দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়নি বলে জানান তিনি।
সংঘাত, সংঘর্ষ, খুনোখুনি আর লুটপাট বন্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ চেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রুমন মিয়া চৌধুরী বলেন, মাতারগাঁও যে খুন হয়েছে সেটির বিচার হোক সেটা আমরা চাই। কিন্তু এভাবে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর লুটপাট হচ্ছে এটা কাঙ্কিত নয়। এটি বন্ধে পুলিশের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই ইউপি সদস্য।
খুনোখুনি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ^াস দিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামি ধরার চেষ্টা চলছে। শুনেছি কিছু বাড়িঘর ভাঙচুর হয়েছে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সাম্প্রতিক সময়ে দিরাই উপজেলায় সংঘর্ষের ব্যাপারে পুলিশ সুপার আ.ফ.ম আনোয়ার হোসেন খান বলেন, আমি কিছু দিন হলো জেলায় এসেছি। দিরাইয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। উপজেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। দিরাই উপজেলার ক্রমবর্ধমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অবসান ও জড়িতদের শাস্তির দাবি ভোক্তভোগী পরিবারের।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ